সাদা ফুল

                                          

 By Souvik Mahapatra 


"আমাকে মা বাবা ভালোবাসে না গো ঠামা। কেউ আমাকে চায় না।" কাঁদো কাঁদো মুখে বলল টুপাই। শ্রোতা সুমিতা রায়।কথা গুলো শুনে টুপাই কে বুকে টেনে নিলেন সে সুমিতাদেবী। এই টুকু ৫ বছরের বাচ্চা কে তিনি বোঝাবেন কি করে কেনো আজ তার জন্মদিনে বাবা মা থাকতে পারছে না। আসলে টুপাইয়ের বাবা ড: অভিরুপ রায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। মা ড: নীলা রায় ও একজন চিকিৎসক। এমনিতেই দুজনেই ব্যস্ত থাকে। করোনার জন্য এখন চাপ আরো বেশি।শেষ ১০ দিন বাড়ি ই আসেনি দুজনেই। ঠামার কাছেই আছে ছোট্ট টুপাই। আজ ওর জন্মদিন। ৫ বছরের জন্মদিন। নীলা আগের বছর থেকেই অনেক প্ল্যান করে ছিল এই ৫ বছরের জন্মদিন নিয়ে। ভেবে ছিল কোনো অনাথ আশ্রমে গিয়ে সারা দিন কাটবে। কিন্তু করোনা সব ওলট পালট করে দিল। নিজে এক কোভিড হোমে পোস্টিং পেলো। আর অভিরূপ এমনিতেই একটা সরকারি হাসপাতালে নিযুক্ত। তাই টুপাই এর জন্মদিনটা একদম সাদামাটা ভাবেই পালন হচ্ছে ঠামার কাছে। কিন্তু এত কথা এই বাচ্চা কে তিনি বোঝাবেন কি করে। ছোট নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুমিতাদেবী বললেন -

ভাই তোমার বাবা মা তো ডাক্তার। তাই ওদের অনেক চাপ অনেক দায়িত্ব। কাজে না গেলে অনেক লোক চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবে। সেটা কি তুমি চাও?
ছোট টুপাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো-
না না তাহলে আসতে হবে না। 
- আচ্ছা বাবা মা কি অনেক বড়ো ডাক্তার? 
সবাই বাবা মা কে ভালোবাসেন?

ছোট ছেলের কথা শুনে সুমীতাদেবী হেসে উঠলেন। বললেন-
হ্যাঁ গো ভাই, সবাই তোমার বাবা মা কে খুব ভালোবাসেন, অনেক সম্মান করেন।

- আমিও ডাক্তার হবো ঠামা। বাবা মার মতো।
সুমিতাদেবী হেসে বললেন
- হ্যা তুমিও ডাক্তার হবে, বাবার থেকেও বড়ো, অনেক লোককে সেবা করবে তুমি। প্রচুর পড়তে হবে কিন্তু তোমাকে।

- আমি পড়ব ঠামা । তুমি দেখে নিও।
নাতির কথা শুনে তাকে বুকে টেনে আদর করে দিলেন তিনি।


ঢং ঢং। ঘড়িতে ১১ টা বাজলো। 
ভাই অনেক রাত হলো ঘুমিয়ে পড়ো এবার। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কাল তো বাবা মা আসবে। দেখা করতে হবে না ? 
ছোট নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজের ছেলের মুখটা মনে পড়ে গেল। 

পড়া পাগল ছেলে ছিল একদম। যেদিন প্রথম চাকরিতে যোগ দিলো সেদিন সে কি খুশি। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলেছিল। আজ ওর স্বপ্ন সফল। মানুষের সেবা করতে পারছে। মাঝখান থেকে এই বাচ্চা ছেলেটা ছোট থেকে বাবা মার সান্নিধ্য পাচ্ছে না। তা না পাক, আমি ওর সব দায়িত্ব পালন করবো। ওরা লোকের সেবা করুক। তাতেই আমি খুশি। টুপাই ও বড়ো হলে বুঝতে পারবে।
এই সব ভাবতে ভাবতেই সুমিতাদেবীর চোখটা লেগে গেছিলো।
হটাৎ সামনের ঘরে রাখা ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। 
- ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
এত রাতে কার ফোন ? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রায় ১২ টা বাজতে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোন টা ধরলেন।

ওপাশ থেকে বৌমার কাপা কাপা গলা শুনতে পেলেন।
- মা, তোমার ছেলে আইসিইউ তে ভর্তি। আমি যাচ্ছি। তোমরা সাবধানে থেকো। আর টুপাইকে কিছু বলো না এখন। 

- কিন্তু কি করে কি হলো......

সুমিতদেবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে গেলো। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন তিনি। 
এই তো সুস্থ ছিল। হটাৎ কি হলো, করোনা নাকি? কিছু ভাবতে পারলেন না সুমিতাদেবী।
বৌমার নাম্বার টা আবার ডায়াল করলেন। কিন্তু ফোন লাগলো না। আবার করলেন। তাও হলো না।
টলতে টলতে নিজের রুমে নাতির কাছে এসে বসলেন তিনি। কাঁপা হাতে মোবাইল নিয়ে ছোট ছেলেকে ফোন করলেন। সব বললেন।

ছোট ছেলে দেশের বাড়িতে থাকে। জায়গা জমির কারবার। মায়ের কথা শুনে মাকে সান্তনা দিয়ে বলল,
- তুমি ভেবো না মা দাদার কিছু হবে না।আমি দেখছি। 
- কিন্তু...
- কোনো কিন্তু নয় মা। তুমি টুপাই কে নিয়ে সাবধানে থেকো। একদম চিন্তা করোনা। 
- আচ্ছা। একটু দেখ বাবা...
বলে ফোন টা রেখে দিলেন তিনি।

ফোনটা টা রেখে দিয়ে তিনি দেখলেন টুপাই উঠে বসেছে।
-কি হোয়েছে ঠামা ? কে ফোন করেছে? বাবা?
- না ভাই , তোমার কাকু করেছিল। বলল তোমার জন্য কি একটা কিনেছে। তুমি ঘুমিয়ে পরো। কাল ভিডিও কল করে দেখাবে। 
- সত্যি?
হ্যা গো ভাই। তুমি ঘুমিয়ে পরো দেখি, অনেক রাত হলো।
এই বলে তিনি নাতির পাশে এসে শুলেন। কি এক অজানা ভয়ে সুমিতাদেবী দরদর করে ঘেমে গেছেন একদম। 
কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করলেন বিছানায়। শেষে আর থাকতে না পেরে ফোনটা নিয়ে বৌমাকে কল করলেন। কিন্তু এবার ফোন সুইচ অফ বলল। 
বুক টা ধড়াস করে উঠলো সুমিতাদেবীর । প্রচণ্ড কাঁদতে ইচ্ছে করলেও নাতির কথা ভেবে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলেন।
সারা রাত এই ভাবেই কেটে গেলো। 


কাকিমা , ও কাকিমা । 
ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন পাশের বাড়ির পিন্টু চোখ মুখে আতঙ্ক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সারা শরীর ঘামে ভেজা। হাতে একটা খবরের কাগজ।
সর্বনাশ হয়ে গেছে গো, আর্তনাদ করে উঠলো পিন্টু। ইতিমধ্যে পিন্টুর স্ত্রী ও আরো কিছু প্রতিবেশী চলে এসেছে। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত।
দাদা আর নেই গো - বলেই কেঁদে ফেললো পিন্টু।
কামিনী দেবীর মাথা ঘুরিয়ে গেলো। প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনরকমে লোকজন ধরে চেয়ারে বসালো।

তুমি খবর পাওইনি? কাল রাতেই সব শেষ কাকিমা। বৌদিও... - কথা শেষ করতে পারলো না পিন্টু। 
সূমিতাদেবী চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন। কাল রাত থেকে জমানো সব কান্না বাঁধভাঙা পাগল নদীর মত বেরিয়ে এলো।
পিন্টু তার স্ত্রী কে বলল- রানী, তুমি টুপাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাও.. আর হ্যা কিছু বলো না ওকে এখন।

সেই মতো রানী ঘুমন্ত টুপাইকে কোলে করে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলো।
ইতিমধ্যে বাকিরা সুমিতাদেবীকে একটু শান্ত করেছে। 
সুমিতাদেবী খবরের কাগজটা কোলে তুলে নিলেন।
প্রথমেই একটা নির্মল হাসিওয়ালা মুখের দিকে চোখ আটকে গেলো, আর সেই মুখ টা আর কারুর 
নয়, ড: অভীরুপ রায় এর। 
উপরে বড়ো বড় করে হেডলাইন
"শহরের বুকে আবার চিকিৎসক নিগ্রহ, গ্রেফতার ০"

"ঘটনাটি ঘটেছে হরিপুর সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল এ। হাসপাতাল সূত্রে খবর গত রাত ১১ টা নাগাদ পথ দূর্ঘটায় আহত স্থানীয় রাজনীতিক প্রভাবশালী নেতা অমল সেনের ছেলেকে নিয়ে ওনার আত্মীয়রা হাসপাতালে আসেন। তখনই ওনাকে ইমার্জেন্সী ওয়ার্ড এ ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। ডাক্তারদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও ওনার মাল্টিপল অর্গান ফেলিওর করে। রাত ১১. ২০ নাগাদ ওনার মৃত্যু হয়। রোগীর পরিজনরা চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগ তোলে হাসপাতাল ভাঙচুর করে। সেই সময় ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন ড: অভীরূপ রায়। ওনাকে বেধরক মারা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওনাকে হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়। রাত ১১.৪৫ নাগাদ ওনার মৃত্যু হোয়। পুলিশ সূত্রে খবর, ওনার মাথায় গভীর ক্ষত ছিলো। চোখেও গুরুতর আঘাত লেগেছিল। অমল রায় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। চিকিৎসকের স্ত্রী ড: নীলা রায় স্বামীর উপর হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসছিলেন। উনি বেলগাছিয়া কোভিড হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। কোভিড হসপিটাল থেকে জেনারেল হসপিটালে আসায় ওনার ওপর স্থানীয়রা চড়াও হয়। ওনার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আহত অবস্থায় ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর ওনার অবস্থা স্থিতিশীল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের ব্যাপারে ড: বিভাস মান্না বলেন," উনি সমস্ত রুল মেনেই এসেছিলেন। তাই ওনার মাধ্যমে কোভিড ছড়াবে এই ধারণা একেবারেই ভুল।" দুটি ঘটনাতেই এখনো পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। "


এতক্ষণ যা পড়ছিলেন টা শুধু অভিরুপের নয়, যে কোনো ডাক্তার এর জীবনেই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। 
হ্যাঁ, প্রতিবাদ হয়েছিল, খুব হয়েছিল। ফেসবুক টুইটারে মোমবাতি হাতে হাতে প্রতিবাদী মানুষের ছবি নতুন ট্রেন্ড হয়ে উঠেছিল। আর সেই হাজার হাজার ছবির ভিড়ে একটা ছবির সেই অমল সেনের ও ছিলো। মোমবাতি হাতে ওনার ছবির নিচে লেখা ছিলো দুটো শব্দ - "ধিক্কার জানাই।"
কিন্তু কাকে ? কোনো উত্তর নেই। কারোর কাছেই নেই। 
প্রতি বছরের মতো এ বছর ও হাজার হাজার ছেলে মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তারি পড়তে আসবে। বছরের পর বছর, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে এই "মহৎ" প্রফেশন এর পেছনে নিজের জীবন দেবে। একদিন এদের মধ্যেই কেউ আবার অভিরূপের জায়গা নেবে। স্থান হবে কোনো চিতায় বা কবরে। সেই ফাঁকা স্থান আবার কোনো নতুন কুড়ি এসে ভর্তি করে দেবে। মার খাওয়াটাই তো এখন ডাক্তার এর জীবনের ভবিতব্য। তাই নয় কি ?
................................................................................................................................................................................................

আর্টিক্যালটা পরে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে একটু রাস্তায় ধারের বারান্দায় এসে দাড়ালাম। দেখি পাশের বাড়ির কেষ্টদার ভাইপো এসেছে। কি মিষ্টি দেখতে ছেলেটা। আর ভারী ভদ্র ব্যবহার। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো হাসি মুখে। 
- কেমন আছো কাকু ? পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করল। 
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম এই আছি রুকু।
- কাকু, একটা ভালো খবর দেওয়ার আছে। 
আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম কি খবর রে?

- আমি ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছি কাকু।সরকারি কলেজে।

আমার উৎসাহের বেলুন নিমেষে চুপসে গেল। 
তাও যতটা সম্ভব হাসি মুখে বললাম এতো দারুন খবর রে। 
- বাবা মা খুব খুশি গো কাকু। বিকেলে আসবে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। এখন আসি কাকু।
এই বলে রুকু চলে গেলো।
আমিও চুপ চাপ রাস্তার দিকের নয়নতারা গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
নতুন কুড়ি এসেছে গাছটায়। আর
কিছু সাদা ফুল  নিতান্ত অবহেলায় রাস্তায় পড়ে আছে।
সাদা ফুল !! 




Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

শব্দছন্দ #২ অভিমানী বিহঙ্গম

শব্দছন্দ #১